ড. মুহা. বিলাল হুসাইন
তাঁর প্রকৃত নাম বিলাল। তবে তিনি সর্বসাধারণের কাছে বিলাল হুসাইন নামে সর্বাধিক পরিচিতি। তাঁর পিতার নাম মুহা. আবুল কাশেম খাঁ। তিনি দক্ষিণ খুলনার ঐতিহ্যবাহী খাঁ বংশের সন্তান। তিনি ছিলেন একজন খোদাভীরু, উদার ও দানশীল ব্যক্তি। তিনি নিজ এলাকার সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাতার নাম ছিল হামিদা খাতুন। তিনি ছিলেন অন্তাবুনিয়া গ্রামের সরদার বংশের একজন স্বনামধন্য রমনী। সরদার বংশের আভিজাত্য ও ঐতিহ্য ছিল। লেখকের বংশানুক্রম নিম্নরূপ: বিলাল হুসাইন ইবন আবুল কাশেম ইবন আরিফ হুসাইন ইবন মাদার হুসাইন।
বিলাল হুসাইন ১৯৭৭ সালের পহেলা জানুয়ারী খুলনা জেলার অন্তর্গত কয়রা উপজেলার কালনা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কয়রা উপজেলার কালনার গ্রাম সকলের নিকট অত্যন্ত পরিচিত। গ্রামটিকে অনেকে মৌচাকের সাথে তুলনা করে। কারণ এ গ্রামেই রয়েছে দক্ষিণ খুলনার ঐতিহ্যবাহী কালনা আমিনিয়া বহুমুখী ফাজিল মাদ্রাসা। খুলনাসহ আশে পাশের জেলা থেকে অসংখ্য কৃতি শিক্ষার্থী এখান থেকে জ্ঞান আরোহণ করে সারাদেশে জ্ঞান বিতরণে নিয়োজিত আছেন। লেখক ছিলেন পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। ছোট বেলা থেকেই তিনি ভদ্র, নম্র ও আদর্শবান ছিলেন। প্রত্যেকটি কাজকর্মে তাঁর অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে তীক্ষ্ণ মেধা পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহ্যবাহী খাঁ বংশে পিতা মাতার স্নেহ ও মমতায় শৈশবের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়।
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিক পরিবেশেই শুরু হয়। এরপর বাড়ীর পাশে কালনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হন। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। লেখকের পিতা অত্যন্ত ধর্মভীরু হওয়াতে সন্তানকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ঐতিহ্যবাহী কালনা আমিনিয়া বহুমুখী ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। এ সময় মাস্টার বদর উদ্দীন সাহেবের কাছে তিনি পবিত্র কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। তাছাড়া পিতার নিকট আগত বিদ্বান ব্যক্তিদের সাহচর্যে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করে নিজের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়াকালীন সময় তিনি অধ্যক্ষ মাওলানা নাজমুস সাদাত এর নিকট তাফসীর শাস্ত্র, উপাধাক্ষ্য মাওলানা মাহফুজুর রহমানের নিকট ব্যাকরণ শাস্ত্র, মাওলানা মতলুব হুসাইনের নিকট হাদীছ শাস্ত্র, মাওলানা আতাউল গনীর নিকট আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং মাওলানা আ.খ.ম তমিজ উদ্দীনের নিকট ইংরেজী সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। তিনি কালনা আমিনিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আলীর নিকট সকল বিষয়ের উপর লেখাপড়া ও দিক নির্দেশনা নিতেন। তিনি সব সময় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার পরামর্শ দিতেন। এ সময় কালনা আমিনিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৯১ সালে দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ও ১৯৯৩ সালে আলিম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী বিভাগে ভর্তি হন এবং জ্ঞানের জগতে বিচরণ করেন। এখানে থেকে ১৯৯৬ সালে বি.এ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং অনুষদে প্রথম ও ১৯৯৭ সালে এম.এ (থিসিস) গ্রুপ থেকে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্টের কারণে তিনি অগ্রণী ব্যাংক স্বর্ণপদক, বিশ্ববিদ্যালয় পদক ও নবাব আব্দুল লতিফ হল স্বর্ণপদক সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন বিদ্বগ্ধ পণ্ডিত প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম স্যারের নিকট 'আলী (রা.) এর জীবন ও তাঁর কাব্য প্রতিভা শিরোনামে এম.এ থিসিস সমাপ্ত করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন স্বনামধন্য প্রফেসর, বিশিষ্ট ইসলামীক স্কলার, খ্যাতিমান পণ্ডিত প্রফেসর ড. এস.এম. আব্দুছ ছালাম ও প্রফেসর ড. মো. নিজাম উদ্দীন স্যারের তত্ত্বাবধানে ২০০৬ সালে “আরবী গদ্য সাহিত্যে মাহমুদ ইবন 'উমার আয যামাখশারীর অবদান" শিরোনামের উপর পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। এ সময় তিনি বহু কবিতা, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, জ্ঞানপূর্ণ প্রবাদ বাক্য ও কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখালেখি করেন। যা পরবর্তীতে জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
ড. বিলাল হুসাইন ৭ (সাত) ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। ৭ (সাত) ভাইবোনের মধ্যে ৬ (ছয়) জনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত আছেন। তিনি ২০০৪ সালে নাজমা আক্তারের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। নাজমা আক্তারের পরিবার এলাকায় সুপরিচিত ও অভিজাত। তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে মির্জাপুর স্কুল এণ্ড কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রভাষক পদে কর্মরত আছেন। তাদের পরিবারে নাবিহা তাহসিন, যারীন তাসনীম ও ফাওজিয়া ইয়াসমিন নামে তিনটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
শিক্ষাজীবন সমাপনান্তে ২০০২ সালে রাজশাহীর উপশহরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এণ্ড কলেজে যোগদান করেন। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে তিন বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর ২০০৬ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এরপর তিনি ২০০৭ সালে সহকারী অধ্যাপক, ২০১৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ২০১৮ সালে প্রফেসর পদে উত্তীর্ণ হন। ২০১৮ সালের পর থেকে তিনি এ পদে কর্মরত আছেন।
ড. বিলাল হুসাইন তীক্ষ্ণ মেধা, উপস্থিত বুদ্ধি এবং প্রখর মুখস্থ শক্তির অধিকারী। তিনি যে কোন সময় যে কোন বিষয়বস্তুর উপর তাৎক্ষনিকভাবে লেখালেখিতে পারঙ্গম। বর্তমান সময়ের জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সভ্যতার আলোকে তিনি নিজেকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলেন। তাই তাঁর লেখা-লেখনীতে নিত্য নতুন অভিনব বিষয় পরিলক্ষিত হয়। তাঁর অনুবাদ সাহিত্যের প্রত্যেকটির ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। নিম্নে তাঁর সাহিত্য সাধনার উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো,
এটি একটি কাব্যের অনুবাদ গ্রন্থ। আরবী বিভাগের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মো. নিজাম উদ্দীন ও প্রফেসর ড. মুহা. বিলাল হুসাইন এর যৌথকর্ম। এখানে শারফুদ্দীন আল বৃসীরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাঁর কাসীতুল বুরদাহ কবিতার অনুবাদ ও শব্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০১৫ সালে রেনেসাঁ পাবলিকেশন, রাজশাহী থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালে একই প্রকাশনী দ্বিতীয়বার প্রকাশ করে।
এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এখানে হযরত আলী (রা.) এর বিস্তারিত জীবনী উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া হযরত আলী (রা.) দীওয়ান থেকে নির্বাচিত কবিতা এনে তার অনুবাদ করা হয়েছে। যেটি রাজশাহীসহ বাংলাদেশের বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আরবী বিভাগের সিলেবাসভূক্ত রয়েছে। বইটিতে 'আলী (রা.) এর বিখ্যাত আলিফবিহীন ও নুকতাবিহীন ভাষণসহ বেশকিছু ভাষণ ও তাঁর নির্বাচিত কিছু আমসালের অনুবাদ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০১৮ সালে হামিদা পাবলিকেশন রাজশাহী থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। === ৩. আরবী সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ড (জাহিলী যুগ ও ইসলামী যুগ)تاريخ الأدب العربى الجزء الأول العصر الجاهلي والعصر الإسلامي === এটি একটি ইতিহাস গ্রন্থ। আরবী সাহিত্যের ইতিহাস লেখার প্রথম ধাপ হিসেবে এখানে জাহিলী যুগ থেকে ইসলামী যুগ পর্যন্ত প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বইটিতে জাহিলী ও ইসলামী যুগের পদ্য ও গদ্য সাহিত্য এবং এ উভয় যুগের উল্লেখযোগ্য কবিদের জীবনী ও কাব্য সাধনা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২২ সালে হামিদা পাবলিকশন প্রথম প্রকাশ করে।
এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এখানে ইমরু উল কায়স এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাঁর পুরো মু'আল্লাকার শব্দ বিশ্লেষণ ও অনুবাদ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২১ সালে হামিদা পাবলিকশন প্রথম প্রকাশ করে।
এটি একটি জীবনী ও অনুবাদ গ্রন্থ। এখানে কা'ব ইবন যুহায়র (রা.) এর জীবনী ও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাসীদা কাসীদাতু বানাত সু'আদ এর অনুবাদ ও শব্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২০ সালে রাজশাহী থেকে হামিদা প্রকাশনী প্রথম প্রকাশ করে।
এটি একটি জীবনী ও অনুবাদগ্রস্থ। এখানে আবুল 'আলা আল মা'আররীর সংক্ষিপ্ত জীবন পরিক্রমা ও তাঁর রচিত আল মাখলুকাতু 'আবীদুল্লাহ কবিতাটির অনুবাদ ও শব্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কবিতাটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সিলেবাসভূক্ত রয়েছে। গ্রন্থটি ২০২১ সালে রাজশাহী থেকে হামিদা পাবলিকেশন প্রথম প্রকাশ করে।
এটি মূলত অনুবাদ গ্রন্থ। এখানে লাবীদ ইবন রাবী'আহ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাঁর রচিত মু'আরাকাহর অনুবাদ ও শব্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২২ সালে রাজশাহী থেকে হামিদা পাবলিকেশন প্রথম প্রকাশ করে।
টি একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এখানে যুহায়র ইবন আবী সুলমার জীবনী ও তাঁর মু'আলাকাহর শব্দ বিশ্লেষণ ও অনুবাদ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২৩ সালে হামিদা পাবলিকেশন প্রথম প্রকাশ করে।
এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ । এখানে খানসা বিনত 'আমর এর জীবনী ও তার কবিতা এর অনুবাদ ও শব্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গ্রন্থটি ২০২৩ সালে রাজশাহী থেকে হামিদা পাবলিকেশন প্রথম প্রকাশ করে।
ড. বিলাল হুসাইন এর আরবী সাহিত্যের উপর প্রত্যেকটি বই ও অনুবাদ পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। লেখকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে ২১ (একুশ) টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া একটি মাস্টার্স থিসিস তত্ত্বাবধান করেছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ১টি এম.ফিল ও ৮ (আট) টি পি-এইচ.ডি. সম্পন্ন হয়। দেশ ও দেশের বাইরে প্রায় ২০টিরও বেশী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। তাছাড়া জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, ইতিহাস একাডেমী ও এশিয়াটিক সোসাইটিসহ বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জীবন সদস্য। ড. মুহা. বিলাল হুসাইন আরবী সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা অনুবাদক। তিনি যেমন প্রসিদ্ধ সাহিত্য সমালোচক ও গবেষক। তাঁর লেখা লেখনী সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। বিশেষ করে আরবী অনুবাদ গ্রন্থ রচনায় তিনি ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
তিনি সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী।